কেনাকাটা, টেন্ডার, নিয়োগ-সর্বত্রই লুটপাট।
ডিজির বিরুদ্ধে তদন্তে দুদক।
‘রেল পলিটিক্স’ বলে মন্ত্রীর উষ্মা প্রকাশ।
কোনো কিছু কেনার নাম করে টাকা মেরে দেয়া, কোচ-ইঞ্জিন কেনার নাম করে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় স্বজনপ্রীতি, নিয়োগে দুনম্বরী, তেলচুরি, টিকিট বিক্রিতে কালোবাজারি, একের পর এক অনিয়মে ডুবছে রেল খাত। আর এই মাত্রাহীন দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে বিপুল পরিমাণ অর্থ যেমন লোপাট হচ্ছে, তেমনি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে উন্নয়নের গতি। ঠিকমতো কাজ না করায় একের পর এক দুর্ঘটনায় পড়ছে সাধারণের পছন্দের পরিবহন রেলগাড়ি। রেলের উন্নয়নের জন্য ঋণ করে আনা অর্থের বেশির ভাগ অংশ মেরে খাওয়ার প্রক্রিয়ায় সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও জড়িয়ে পড়েছেন। সম্প্রতি রেলের নানা অনিয়মের নথি ঘেঁটে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, রেল খাতের দুর্নীতি না থামানো পর্যন্ত এর কোনো উন্নতি হবে না। অথচ জনপ্রিয় এই পরিবহনের উন্নতির জন্য কর্তাব্যক্তিরা দিনের পর দিন শুধু প্রতিশ্রæতিই দিয়ে এসেছেন। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বছর দুয়েক আগে রেলমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে নূরুল ইসলাম সুজনও হুংকার ছেড়ে বলেছিলেন, রেলের দুর্নীতি তিনি শূন্যে নামিয়ে আনবেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির কথা জানিয়ে তিনি বলেছিলেন, এখানে দুর্নীতি করে কেউ টিকতে পারবে না। তবে দুর্নীতি থামেনি; কাক্সিক্ষত উন্নয়নও হচ্ছে না রেলের।
রেলের কেনাকাটার বিভিন্ন নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, গত ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে রেলের আধুনিকায়নের নামে তালা, বাঁশি, বালতি ও ঝাণ্ডাসহ ২০ ধরনের পণ্য কেনাকাটায় ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে বলে তদন্ত রিপোর্টে উঠে এসেছে। এর ফলে কয়েক কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। এ ঘটনার পর রেল মন্ত্রণালয় একটি তদন্ত কমিটি করে। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আবদুর রহিমকে প্রধান করে গঠন করা ওই কমিটি রেলমন্ত্রীর কাছে গত ৯ ডিসেম্বর তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কেনাকাটায় টাকা মেরে দেয়ার সঙ্গে রেলের ১৭ কর্মকর্তা জড়িত। এদের মধ্যে চার জনকে বরখাস্তসহ বিভাগীয় ও ফৌজদারি মামলা এবং ১৩ জনের বিরুদ্ধে শুধু বিভাগীয় মামলা করার কথা বলা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে।
তদন্ত প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, রেলের জন্য ১৩৩ টাকার তালা কেনা হয়েছে ৫ হাজার ৫০০ টাকায়, ২০০ টাকার বালতি ১ হাজার ৮৯০ টাকায়, ৫০ টাকার বাঁশি ৪১৫ টাকায় এবং ৭৫ টাকার ঝান্ডা কেনা হয়েছে ১ হাজার ৪৪০ টাকায়। একইভাবে অন্যান্য পণ্যও কেনা হয়েছে বাজারমূল্যের চেয়ে ১৫ থেকে ৩৩ গুণ বেশি দরে।
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ওই অর্থবছরে রেলের কেনাকাটার জন্য তালিকাভুক্ত ঠিকাদার রয়েছেন ১৬৬ জন। কিন্তু পণ্য কেনার জন্য মাত্র ৬ জন ঠিকাদারের কাছে দরপত্র বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয়েছে। ১৬৬ জনের মধ্যে মাত্র ৬ জন ঠিকাদারকে দরপত্র বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে পণ্য কেনাকাটার বিষয়টিও গুরুতর আর্থিক অনিয়ম হিসেবে দেখেছে তদন্ত কমিটি।
জানতে চাইলে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, রেলের জন্য মালামাল কেনাকাটার ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি আমার কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনে তারা বেশ কিছু অনিয়ম প্রমাণসহ তথ্য তুলে ধরেছে। এ জন্য কয়েকজনকে দোষি সাব্যস্ত করা হয়েছে। তাদের শাস্তির বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রী।
এদিকে যাত্রী সেবার মান বাড়াতে ২০১৭ সালে ইন্দোনেশিয়া থেকে ২০০টি মিটারগেজ রেলগাড়ির কোচ কেনা হয়েছিল। কোচগুলো কিনতে ব্যাপক ঘুষ লেনদেন হয়েছে এবং এতে রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. শামছুজ্জামানসহ ঊর্ধ্বতন কয়েকজন জড়িত উল্লেখ করে দুদকে অভিযোগ জমা পড়েছে। অভিযোগ পাওয়ার পর রেলওয়ে মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে দুদক তদন্ত কাজ শুরু করেছে বলে জানা গেছে। দুদকে জমা দেয়া অভিযোগ থেকে জানা গেছে, অযোগ্য কোম্পানিকে কাজ দিতে এসব কোচ কেনায় দরপত্রের শর্ত পাল্টে দেয়া হয়। এতে কোচগুলো সরবরাহের কাজ পায় ইন্দোনেশিয়ার ‘পিটি ইনকা’ নামের একটি কোম্পানি। এ জন্য কয়েক কোটি টাকার ঘুষ লেনদেন হয়, যার সঙ্গে শুধু মহাপরিচালক নয়; অনেকেই জড়িত বলে দুদকে অভিযোগ করা হয়েছে। আবার এ ঘুষের টাকা ডিজি দেশের বাইরে পাঁচার করেছেন বলেও অভিযোগ করা হয়েছে।
এদিকে, রেলের ২৬০০ ও ২৭০০ গ্রুপের ইঞ্জিন মেরামতের জন্য ১৫টি ট্রাকশন মোটর কানাডার ফেরদৌস ইন্টারন্যাশনাল থেকে আনা হয়। কিন্তু এগুলো খুবই নিম্নমানের। তখন এই ইঞ্জিন মেরামতের পণ্য কেনাকাটা সংক্রান্ত কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন বর্তমান ডিজি মো. শামছুজ্জামান। এ ছাড়াও ১৪ বছর আগে ২০০৬ সালে রেলভবনে সিএমই/প্রজেক্ট থাকাকালে বরাদ্দের বাইরে আট কোটি টাকা খরচ করেন মহাপরিচালক। ওই কাজের পরও তার বিরুদ্ধে অডিট আপত্তি ওঠে।
এদিকে রেলে অডিটর পদে দুর্নীতির মাধ্যমে অযোগ্য প্রার্থীকে নিয়োগের অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলায় রেলওয়ের সাবেক ও বর্তমান ১৩ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দিয়েছেন আদালত। মামলার নথি থেকে জানা যায়, ২০১১ সালের ২৭ মার্চ রেলওয়েতে অডিটর পদে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে দরখাস্ত আহŸান করা হয়। এতে মোট ৭ হাজার ১৩টি আবেদন জমা পড়ে। ৫ হাজার ১০৮ জন বৈধ আবেদনকারীর মধ্যে ১ হাজার ৯৪৩ জন ওই বছরের ২৮ অক্টোবর লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন। লিখিত পরীক্ষায় ১ হাজার ৮৫ জন উত্তীর্ণ হন। এদের মধ্যে কোটাভিত্তিক ২১৭ জনকে মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেয়ার অনুমতি দেয়া হয়। ওই বছরের ৩১ ডিসেম্বর থেকে ২০১২ সালের ৪ জানুয়ারি পর্যন্ত ১৯৬ জন প্রার্থী মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেন। ওই বছরের ২৫ জানুয়ারি টেবুলেশন শিট তৈরি করে ওইদিনই ৬৩ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করে নিয়োগ কমিটি।
২০১২ সালে রেলওয়ের নিয়োগ নিয়ে দুদকের অনুসন্ধানে দেখা যায়, পোষ্য কোটায় পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান অধিকারী প্রার্থীকে বাদ দিয়ে নিয়োগ কমিটির সদস্যরা পরস্পর লাভবান হয়ে সপ্তম হওয়া প্রার্থীকে নিয়োগ দেয়ার সুপারিশ করেছেন এবং তিনি নিয়োগ পেয়েছেন। মামলার অভিযোগপত্রে নিয়োগ পাওয়া ওই প্রার্থী হোসনা আক্তারকেও আসামি করা হয়। এছাড়া রেলের জন্য ডেমু ট্রেন কেনা থেকে দুর্নীতি হয়েছে বলে জানা যায়। বর্তমানে এই ডেমু মেরামতের জন্য মালামাল কেনাকাটায়ও ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এ ছাড়া রেলের তেল চুরির ঘটনা যুগ যুগ ধরে ঠেকাতে পারেনি রেলওয়ে। তেমনি দেশের বিভিন্ন স্টেশনে টিকেট কালোবাজারি এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। আবার সিডিউল বিপর্যয় ঠেকাতে বাড়ানো হয়েছে রানিং টাইম, কমানো হয়েছে গতি বেগ, এমনি নানা অভিযোগ ও অনিয়ম রয়েছে রেলের বিরুদ্ধে। যা ঠেকাতে পারেননি রেলের মন্ত্রী-সচিব-মহাপরিচালকরা।
দুদক থেকে জানা যায়, রেলের কোচ কেনায় মহাপরিচালকসহ অন্যান্যদের বিরুদ্ধে তদন্তের জন্য দুদকের সহকারী পরিচালক (মানি লন্ডারিং) মামুনুর রশীদ চৌধুরীকে প্রধান করে দুই সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। জানতে চাইলে মামুনুর রশীদ চৌধুরী ভোরের কাগজকে জানান, দুদকে ২০০ মিটারগেজ কোচ কেনার বিষয়ে রেলের ডিজিসহ বেশ কয়েকজন দুর্নীতি করেছেন এবং মানি লণ্ডারিং এ জড়িত বলে আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছে। আমরা এ কেনাকাটার বিষয়ে সব নথিপত্রসহ তথ্য চেয়ে রেলসচিবের কাছে চিঠি দিয়েছি। এরই মধ্যে তিনি কিছু তথ্য পাঠিয়েছেন। তবে আরো বহু তথ্য প্রয়োজন। মাত্র তদন্ত শুরু হয়েছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত রেলের মহাপরিচালকসহ ঊর্ধ্বতনরা দোষী কিনা তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
তবে রেলওয়ের মহাপরিচালকসহ ঊর্ধ্বতনদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করায় খানিকটা উষ্মা প্রকাশ করেছেন রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন। ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, আমরা এখন দেখছি পত্রপত্রিকায় রেলের দুর্নীতি নিয়ে লেখা হচ্ছে। এর কোনো ভিত্তি আছে কিনা তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে পাল্টা প্রশ্ন করে তিনি বলেন, দুর্নীতির ব্যাপারে আপনারা ইন্দোনেশিয়ান কোম্পানির কাছে কোনো কিছু জানতে চেয়েছেন কি? ওখানে না জেনে এখানে এসে জিজ্ঞেস করছেন কেন? তারমতে, ওই কোম্পানির সঙ্গে কথা না বলেই এখানে এসে ঘুষ লেনদেনের কথা বলে দিচ্ছেন? এই তথ্য পেলেন কোথায়? তবে পুরো বিষয়টি তার নজরে রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। দুদকের তদন্তের বিষয়ে তিনি বলেন, ওরা কিছু কাগজপত্র চেয়েছে, রেলসচিব এটা সরবরাহ করেছেন। তারমতে, এখানে তদন্ত নয়, ‘রেল পলিটিক্স’ কাজ করছে। তিনি কর্মকর্তাদের পক্ষাবলম্বন করে বলেন, বর্তমান রেল মহাপরিচালকের সময় শেষ হচ্ছে। যখন কোনো ডিজির-এডিজির কাজের মেয়াদ শেষের দিকে যায় তখন তাদের বিরুদ্ধে এক শ্রেণির কর্মকর্তারা- যারা এ দৌড়ে আছেন তারা এসব রটনা রটিয়ে দেয়। এটা এক ধরনের পলিটিক্স। এর কোনো ভিত্তি আছে বলে মনে হয় না। তবে দুদক তদন্ত করছে। তারা বের করুক সত্যি দুর্নীতি হয়েছে কিনা। যদি সত্যিই দুর্নীতি হয়ে থাকে তাহলে তারা শাস্তি পাবে।
জানতে চাইলে রেলের মহাপরিচালক মো. শামসুজ্জামান জানান, দুদকের কাছে কে বা কারা অভিযোগ করেছে জানি না। দুদক এসব অনিয়মের বিষয়ে তদন্ত করছে। তাই দুদকের তদন্তনাধীন বিষয়ে বক্তব্য দেয়া ঠিক হবে না।
Leave a Reply