গত বছর ৩০ মার্চ। অসুস্থ শরীর নিয়ে সুমন কল্যাণ দা’র মগবাজারের ডি স্টেশন স্টুডিওতে আসেন দেশবরেণ্য নন্দিত সংগীতশিল্পী সুবীর নন্দী। সংগীত পরিচালক সুমন কল্যাণ দা, সুরকার যাদু রিছিল এবং আমি সুবীর দা’কে সামনে গিয়ে এগিয়ে নিয়ে আসি স্টুডিওতে।
কিছুক্ষণ কুশল বিনিময় করার পর জিজ্ঞেস করলাম দাদা কী খাবেন? বললেন, আমার তো খাবারের অনেক রেস্ট্রিকশন আছে। দেখো ছোট ছোট সিঙ্গারা আর সমুচা পাওয়া যায় কি না? পাওয়া গেলে নিয়ে আসো।
সম্ভবত সিঙ্গারা সমুচা খেতে খুব পছন্দ করতেন সুবীর দা। খেলেন দুটি সিঙ্গারা কিন্তু সিঙ্গারার ভেতরের আলু খেলেন না। আর একটির অর্ধেক সমুচা খেলেন।
সুমন কল্যাণ দার সাথে সুবীর নন্দীর পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। সুমন কল্যাণ দা’র বাচ্চারা কেমন আছে জানতে চাইলেন। তারপর বললেন, এবার চলো গানটি গেয়ে দেবো।
সুমন কল্যাণ বললেন, সবকিছু ঠিক আছে দাদা। হ্যাঁ, চলুন।
‘এখন কেমন আছে বঙ্গবন্ধুর বত্রিশ নম্বর বাড়িটি/ এখন কোথায় আছে বঙ্গবন্ধুর কালো ফ্রেমের চশমাটি/ এখন কোথায় আছে বঙ্গবন্ধুর সেই ইজি চেয়ারটি/ এখন কোথায় আছে শেখ রাসেলের সেই ছবিটি’- বত্রিশ নম্বর শিরোনামের এই গানটি গাইতে গাইতে সুবীর নন্দী রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে শুরু করলেন। বুঝতে পারলাম সুবীর নন্দী এই গানটি গাইতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছেন।
গানটি গাওয়ার পর স্মৃতিকাতর হয়ে সুবীর নন্দী বলেছিলেন, মনে হয় চোখের সামনেই ভেসে উঠছে বঙ্গবন্ধুর বত্রিশ নম্বর বাড়ি, তাঁর মোটা কালো ফ্রেমের চশমা, সেই ইজি চেয়ার এবং শেখ রাসেলের ছবিটি।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কী ভাবছে নতুন প্রজন্ম তাদের সাহিত্যে, গল্প, কবিতা, উপন্যাসে, গানে, নাটকে? তাদের কল্পনায় বঙ্গবন্ধু কেমন? তাদের স্বপ্নের বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গানটি গাইতে পেরে ভাল লাগছে।
তিনি আরো বললেন, বঙ্গবন্ধুর সঠিক ইতিহাস নতুন প্রজন্মকে জানতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না আমাদের মা, মাটিকে। আমাদের জন্মভূমিকে। আমরা যে মাটির উপর দাঁড়িয়ে আছি এখানে ত্রিশ লক্ষ শহীদ এবং দু লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম জড়িয়ে আছে। আমরা যেন শহীদের আত্মত্যাগের কথা কোনদিন ভুলে না যাই। আমরা যেন বাংলাদেশকে মায়ের মত ভালবাসি।
সুবীর নন্দী একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক ছিলেন। অকৃত্রিম ভালোবাসা ছিল তাঁর দেশের প্রতি। বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশ ছিল তাঁর জীবন দর্শন।
‘বঙ্গবন্ধু তুমি স্বপ্ন বাঙালির’ অ্যালবামে সার্কভুক্ত ছয়টি দেশের আটজন শিল্পীর কণ্ঠে সুবীর নন্দীর এ গানটি সংযোজন করার কথা থাকলেও তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আগেই গানটি আমার ব্যক্তিগত ইউটিউব চ্যানেল এসএইচ গ্লোবাল টিভিতে অবমুক্ত করা হয় গত বছর ৯ মে।
দীর্ঘ ৪০ বছর ছিল তাঁর গানের ক্যারিয়ার। তিনি সবমিলিয়ে প্রায় তিন হাজারের মতো গান গেয়েছেন। পেয়েছেন অগনিত মানুষের শ্রদ্ধা এবং ভালবাসা। কী বেতার, কী টেলিভিশন, কী চলচ্চিত্র- সব জায়গায় তিনি অসংখ্য জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন। তাঁর প্রথম একক অ্যালবাম ‘সুবীর নন্দীর গান’ ১৯৮১ সালে প্রকাশিত হয়। ১৯৭৬ সালে আবদুস সামাদ পরিচালিত ‘সূর্যগ্রহণ’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তাঁর প্রথম চলচ্চিত্রে
প্লেব্যাক। চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক করে তিনি পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছেন।
তিনি ২০১৯ সালে সংগীতে অসামান্য অবদান রাখার জন্য দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন।
উল্লেখ্য, গতবছর ১৪ এপ্রিল গুরতর অসুস্থ অবস্থায় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি করা হয়েছিল সুবীর নন্দীকে। তার ঠিক দুই সপ্তাহ আগে ৩০ মার্চ সন্ধ্যায় মগবাজারের ডি স্টেশনে এসেছিলেন তিনি এবং পরে শারীরিক অবস্থা আরো বেশি অবনতি হলে প্রধানমন্ত্রীর মানবিক সহযোগিতায় উন্নত চিকিৎসার জন্য ৩০ এপ্রিল সকালে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে তাঁকে সিঙ্গাপুর নেয়া হয়। আর সেখানেই গতবছর আজকের এই দিনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় না ফেরার দেশে চলে যান কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী সুবীর নন্দী।
গত বছর ৮ মে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রিয় গায়ককে শেষবারের মত শ্রদ্ধা জানিয়েছিলাম। বিদায় জানিয়েছিলাম ফুল দিয়ে, অশ্রু দিয়ে, ভালবাসা দিয়ে।
কে জানত এই গানটি সুবীর নন্দীর শেষ গান হবে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গান বলেই তিনি এসেছিলেন। আজ সুবীর নন্দীর প্রথম প্রয়াণ দিবস। কোথাও নেই কোন স্মরণসভার আয়োজন। ঘরে বসেই তাঁর স্মৃতিচারণ করছি। তাঁর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বত্রিশ নম্বর শিরোনামের শেষ গানটি বারবার শুনছি। তাঁকে শ্রদ্ধা নিবেদন করছি অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে।
সুবীর নন্দী তাঁর গানের মধ্য দিয়ে আজীবন বেঁচে থাকবেন আমাদের হৃদয়ে। তিনি বেঁচে থাকবেন আমাদের ভালবাসা এবং শ্রদ্ধায়
Leave a Reply