একটি দুঃস্বপ্নের ঘোরে ১৩ই মে’র সকাল হয় দক্ষিণ কোরিয়ায় থাকা বাংলাদেশিদের। দ্বিতীয় বাংলাদেশির করোনা শনাক্তের দিনকে তারা ‘আনলাকি থার্টিন’ বা অশুভ-১৩ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ওই ঘটনা দক্ষিণ কোরিয়ার বাংলাদেশি কর্মীদের পায়ে ‘কুঠারাঘাত’! খবরটি যখন বজ্রপাতের মতো সিউলের বাংলাদেশ কমিউনিটিতে আঘাত করে তখনও ঢাকা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ঘটনাটি এতটাই হতবিহ্বল করে পদস্থ বাংলাদেশি কূটনীতিকদের, তারা তখন দিশাহারা-কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কী থেকে কী হয়ে গেল! এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। কীভাবে কন্ট্রোল হবে এই ডেমেজ? স্পেশাল ফ্লাইটে ঢাকাফেরত এক বাংলাদেশির করোনা শনাক্ত হয় আগের দিনে (১২ই মে)। কোরিয়ায় প্রথম বাংলাদেশি করোনা আক্রান্ত বা শনাক্তের রেকর্ড ছিল এটি। বিমানবন্দরেই তার গতি আটকে দেয়া হয়।
সোজা পাঠানো হয় আইসোলেশনে। তাতে অতটা ক্ষতি হয়নি বাংলাদেশের। যতটা হয়েছে কয়েক ঘণ্টা ব্যবধানে (১৩ই মে সকালে) দ্বিতীয় বাংলাদেশি শনাক্ত হওয়ার ঘটনায়। কোরীয় সরকার ততক্ষণে হার্ডলাইনে চলে যায়। দক্ষিণ জিওলা যা জিওলানাম-ডু নামে পরিচিত সেই এলাকায় মোট ১৭টি করোনা কেস শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ওই বাংলাদেশিসহ মোট ৯ জন বিদেশি রয়েছেন। কিন্তু কোরিয়ার সরকার বাকি আট বিদেশির কে, কোন্ দেশের নাগরিক তা প্রচার বা প্রকাশ করেনি। সরকারি ব্রিফিংয়ের বরাতে একমাত্র বাংলাদেশির পরিচয় প্রকাশ হয় এবং দেশটির সংবাদ মাধ্যমে ফলাও করে প্রচার পায়। কিন্তু কেন খোদ কোরিয়ান গভর্নমেন্ট বাংলাদেশি ভিকটিমের পরিচয় প্রকাশ করলো? তার তো দৃশ্যমাণ কোনো অপরাধ নেই। জানার চেষ্টা করা হলে কোরিয়ায় নিযুক্ত এক কূটনীতিক বলেন, দোষ ভিকটিমের নয়। এ জন্য বাংলাদেশ সরকারকও দায়ী নয়। কিন্তু কোরিয়ানদের কে বোঝাবে? তারা যে কারণে সব বিদেশির পরিচয় গোপন রাখলো। কিন্তু বাংলাদেশির পরিচয় প্রকাশ করে ছিলো সম্ভবত তারা আমাদের প্রতি বিরক্ত। এর জন্য কেউ দায়ী না হলেও রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে মূল্য দিতে হচ্ছে!
পদস্থ ওই সরকারি কর্মকর্তা বলেন, দক্ষিণ কোরিয়ায় এতদিন অবস্থানকারী কোনো বাংলাদেশি করোনা আক্রান্ত হয়নি। কারণ তারা কোরিয়া সরকারের নির্দেশনা মেনেছেন অক্ষরে অক্ষরে। তা সর্বত্র প্রশংসা পেয়েছে। ব্যতিক্রম দু’-একটি ঘটনা ছাড়া কোরিয়ায় বাংলাদেশি কর্মীদের কমিটমেন্ট, কাজকর্ম, আচার- ব্যবহারের সুনাম আছে। করোনার এই দুর্দিনে মধ্যপ্রাচ্য এমনকি পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোতে যখন কর্মী ছাঁটাই আতঙ্ক, অনেক বাংলাদেশি কর্মহীন হয়ে দেশে ফেরার ঝুঁকিতে, সেই সময়ে সিউলের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। রাষ্ট্রদূত এ নিয়ে ঢাকায় রিপোর্ট করেছেন। তাগিদ দিয়েছেন বাংলাদেশি ইপিএস কর্মী যারা করোনার ভয়ে ছুটিতে ঢাকায় চলে গেছে তাদের জরুরিভিত্তিতে ফেরাতে। এ অবস্থায় প্রায় সাড়ে ৫শ’ বাংলাদেশি ফেরার প্রস্তুতিতে রয়েছেন। কোরিয়ান একটি বড় বিমানে তাদের ফেরানোর আয়োজন চলছিলো। কিন্তু এই একটি ঘটনা সব ওলটপালট করে দিলো। যদিও বোয়েসেলে কতিপয় অসাধু কর্মচারী এবং কিছু এজেন্টের কারসাজিতে শুরু থেকেই ইপিএস কর্মীদের ফেরা বিলম্বিত হচ্ছিলো। ওই চক্র তাদের নানাভাবে হয়রানি করছিলো মর্মে প্রতিনিয়ত অভিযোগ আসছিলো।
সিউলের কূটনৈতিক সূত্র বলছে, কোরিয়ান সরকার করোনা পরিস্থিতি মোটামুটিভাবে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার পরপরই সব কিছু খুলে স্বাভাবিক করতে শুরু করেছিলো। কিন্তু বাধা পড়ে গেল বিদেশি বা বাইরে থেকে সিউলে ঢোকা ব্যক্তিদের কারণে। আর ওই তালিকায় দুর্ভাগ্যবশত দু’জন বাংলাদেশির নাম স্থান পেয়ে যাওয়ায় এখন বাকি বাংলাদেশিদের ফেরার পথে নানা বাহানা বা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে। দালাল চক্রের দৌরাত্ম্যও বাড়বে। আগে যে খরচে তারা ফিরতে পারতেন চক্রের কারসাজিতে এখন তা দেড় থেকে দুইগুণ হয়ে যাবে!
দূতাবাসের নোটিশে যা বলা হয়েছে: দক্ষিণ কোরিয়ায় দুই বাংলাদেশি করোনা আক্রান্ত হওয়ার পরপরই দূতাবাস একাধিক জরুরি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। প্রথম বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ১২ই মে কোরিয়ান এয়ারের বিশেষ চার্টার্ড ফ্লাইটে দক্ষিণ কোরিয়ায় আসা সব বাংলাদেশি নাগরিকের সদয় অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, উক্ত ফ্লাইটের যাত্রীদের মধ্যে পাঁচজন কোভিড-১৯ পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে তিনজন কোরিয়ান নাগরিক এবং দুইজন বাংলাদেশি নাগরিক রয়েছেন। যারা কোরিয়ায় এসেছে তাদের সর্বোচ্চ সতর্কবার্তা দিয়ে দূতাবাস থেকে বলা হয়েছে যে, ‘উক্ত চার্টার্ড ফ্লাইটে দক্ষিণ কোরিয়ায় আসা সব বাংলাদেশি নাগরিককে কঠোরভাবে ১৪ দিনের সঙ্গনিরোধ বিধি অবলম্বন করার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো। দ্বিতীয় নোটিশে সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে করোনা টেস্ট করতে নির্দেশনা দেয়া হয়। বলা হয়, স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তমতে, কাছাকাছি সবাইকে দ্রুত নমুনা দিতে হবে।
নতুন করে সংক্রমণ, দুশ্চিন্তায় মুন জা ইনের সরকার: এদিকে দক্ষিণ কোরিয়ায় কড়াকড়ি শিথিল করার পরই দ্বিতীয় দফা সংক্রমণ শুরু হয়। দেশটিতে ১০২ জন করোনা আক্রান্তের সঙ্গে সিউলের ব্যস্ততম এলাকা ইতায়ওয়ানের বার ও ক্লাবগুলোর সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। দ্য কোরিয়া হেরার্ল্ড জানায়, ইতায়ওয়ানের ক্লাব ও বারই এখন দক্ষিণ কোরিয়ায় করোনা সংক্রমণের সবচেয়ে বড় ক্লাস্টার। এর মধ্যে বুধবার (১৩ই মে) দেশটিতে নতুন করে ২৬ জনের করোনা শনাক্ত হয়। দক্ষিণ কোরিয়ায় এখন পর্যন্ত (রোববার অবধি) করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ১১ হাজার ৫০ জন। মৃত্যু হয়েছে ২৬২ জনের। সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন ৯ হাজার ৮৮৮ জন। গত ২০শে জানুয়ারি কোরিয়ায় প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এপ্রিলের শেষের দিকে দেশটিতে করোনা প্রায় নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছিলো।
Leave a Reply