প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিপর্যস্ত সারা বিশ্ব।এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে ঘরবন্দি আমরা সবাই।নতুন এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত আত্মরক্ষার প্রধান উপায় হলো সংক্রমণ থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা তথা নিজ নিজ ঘরে অবস্থান করা এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো।কিন্তু আমরা আমাদের অজান্তেই এমন কিছু খাদ্যাভাসকে লালন করছি যা আমাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাকে কমিয়ে দিচ্ছে।এমনকি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে বলে ধারণা করা হয় এমন খাদ্যও শুধুমাত্র অতিরিক্ত খাওয়ার খাদ্যাভাসের কারণেই তা আপনার ইম্যুউনিটি কমিয়ে দিতে পারে।অর্থাৎ খাদ্যাভাসকে বলা যায় শারীরিক ইম্যুনিটি বা রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো বা কমানোর ক্ষেত্রে একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।এখানে আমরা এ ধরনের ৬টি খাদ্যাভাসের কথা তুলে ধরছি:
মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপান
মাঝেমধ্যে অল্পস্বল্প মদ্যপান রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় বলে একটি বদ্ধমূল ধারণা রয়েছে।কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) এ সম্প্রতি যে রিপোর্ট দিয়েছে, তা যথেষ্ট ভয়ের।কারণ সেই রিপোর্টে সাফ জানানো হয়েছে, মদ খেলে কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কয়েক গুণ বেড়ে যায়। হু’র রিপোর্ট অনুযায়ী অ্যালকোহল সেবন করলে ‘কমিউনিকেবল’ এবং ‘ননকমিউনিকেবল’ বিভিন্ন রোগের সম্ভাবনা রয়েছে। যা মানুষকে আরও দুর্বলই করে তোলে।
‘এলকোহল রিসার্চ’ নামক জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধে গবেষকরা উল্লেখ করেছেন, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হওয়ার সাথে অতিরিক্ত মদপানের গভীর সম্পর্ক রয়েছে।এরফলে নিউমোনিয়া ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি পায় বলেও উল্লেখ করা হয়েছে যা এই করোনা মহামারি সময়ে আপনার জন্য মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে।
অতিরিক্ত লবন খাওয়া
যাদের অতিরিক্ত লবন খাওয়ার অভ্যাস আছে তাদের এখনই এটি ত্যাগ করা উচিত।কারণ অতিরিক্ত লবন বা সোডিয়াম গ্রহণের ফলে শরীরে শুধু যে অতিরিক্ত তরল জমা ও উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি করে তাই নয়; এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও দুর্বল করে দেয়।সম্প্রতি জার্মানির ‘ইউনিভার্সিটি হসপিটাল অব বন’র এক গবেষণা থেকে জানা যায়, অতিরিক্ত লবন গ্রহণ রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয়।তারা মানুষ ও ইঁদুর উভয়ের উপরই গবেষণা করে দেখেছেন, কিডনি যখন অতিরিক্ত সোডিয়াম নিঃসারণ করে, তখন তা রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়ার বড় কারণ হয়ে ওঠে।
অতিরিক্ত চিনি খাওয়া
আমেরিকান জার্নাল অফ ক্লিনিকাল নিউট্রিশনে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, সারারাত উপোস করার পরে কিছু মানুষকে সকালে ১শ গ্রাম চিনি খাওয়ানোর ২ ঘন্টা পর পরীক্ষা করে দেখা যায়, তাদের রোগপ্রতিরোধক কোষের ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং তা সর্বাধিক ৫ ঘন্টা পর্যন্ত স্থায়ী হয়।
মাত্রারিক্ত চা-কফি
স্বাভাবিক মাত্রায় চা বা কফি (ক্যাফেইন) খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারী হলেও অতিরিক্ত খাওয়া আবার খারাপ।চা বা কফিতে উচ্চ মাত্রার এ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও এ্যান্টি ইনফ্লামেটরি উপাদান থাকে যা স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারী।কিন্তু অতিরিক্ত ক্যাফেইন ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়।আর পর্যাপ্ত ঘুম না হলে তা শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।
রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাকে ভাল রাখার জন্য সবচেয়ে উত্তম উপায় হলো ক্যাফেইনের সাথে চিনি বা কৃত্রিম মিষ্টি, সোডা ও এনার্জি ড্রিংকের মিশ্রণ ছাড়াই পান করা। এছাড়া ঘুমাতে যাওয়ার অন্তত ছয় ঘন্টা আগে চা-কফি পান বন্ধ করা উচিত বলেও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন।
আঁশ জাতীয় খাদ্য গ্রহণে কার্পণ্য করা
গবেষকরা বলছেন, আঁশ জাতীয় খাবার হজমশক্তি বৃদ্ধি, ভাইরাসের বিরুদ্ধে সুরক্ষা প্রদানের মাধ্যমে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। ওজন কমাতে, রক্তে শর্করা ও চর্বি কমাতে এবং বৃহদন্ত্রের ক্যানসারসহ নানা রোগ প্রতিরোধে চিকিৎসক বেশি করে আঁশযুক্ত খাবার খেতে পরামর্শ দেন। শাক, সবজি, ফলমূল, গোটা শস্য, ডাল (শিম, মসুর ডাল, ছোলা) বাদাম এবং বীজ জাতীয় খাবার থেকে থেকে এই আঁশ পাওয়া যায়।কিন্তু অনেকেই শাক-সবজি খেতে কার্পণ্য করে।আবার অনেকেই সরাসরি ফলমূল খাওয়ার পরিবর্তে প্রক্রিয়াজাত পণ্য ব্যবহার করেন যাতে ফাইবার বা আঁশের উপস্থিতি খুব কম থাকে।বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রক্রিয়াজাত ফাইবারের তুলনায় প্রাকৃতিক ফলমূলে ফাইবার বেশি থাকে।
আমাদের মধ্যে অতিরিক্ত ভাত খাওয়ার অভ্যাস বিদ্যমান।আমরা এটাকে ফল ও বাদাম জাতীয় খাবার বেশি খাওয়ার অভ্যাস করতে পারি।
সচরাচর পাওয়া যায় অথচ আমরা খেতে কার্পণ্য করি এমন আঁশযুক্ত শাক-সবজির মধ্যে কচুশাক, মিষ্টি আলুর শাক, কলমি শাক, পুদিনা পাতা, পুঁইশাক, মুলা শাক, ডাঁটা শাক, লাউ ও মিষ্টি কুমড়ার আগা-ডোগা সাজনা, কলার মোচা, ঢেঁড়স, ডাঁটা, বাঁধাকপি, ফুলকপি, ওলকপি, গাজর, শিম, পটল, কচু, বেগুন, বরবটি ও মটরশুঁটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ফলের মধ্যে সবেচেয় বেশি আঁশ অংশ থাকে বেল, পেয়ারা, কদবেল, আমড়া, আতাফল, নারিকেল, কালোজামের মধ্যে।এছাড়াও গাব, কামরাঙ্গা, পাকা টমেটো, পাকা আম, পাকা কাঁঠাল, আপেল ও আমলকীর মধ্যে মাঝারি পরিমাণে আঁশ থাকে। ডাল- মটর, মুগ ও ছোলার ডালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আঁশ পাওয়া যায়। অন্যান্য- যব, ভুট্টা, আটা, তিল, কাঁচামরিচ ও সরিষাতেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আঁশ অংশ বিদ্যমান।
পর্যাপ্ত সবুজ শাক-সবজি না খাওয়া
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সবুজ শাক-সবজি রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে বিশেষভাবে সহায়ক।এগুলো ভিটামিন এ, সি, ফোলেট ও বায়োঅ্যাকটিভ যৌগ সমৃদ্ধ যা পুষ্টি সরবরাহের পাশাপাশি রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
Leave a Reply