২০২২ সালের ডিসেম্বর মাস। মুম্বাইয়ের বোরিভালি এলাকা থেকে এক তরুণীকে উদ্ধার করে ভারতের রেলওয়ে পুলিশ। ওই তরুণীর অবস্থা তখন করুণ—শয্যাশায়ী, শরীরে অপুষ্টির ছাপ। তাঁর পরনে ছিল বড় আকারের একটি কুর্তি। দেখলে বোঝা যায়, মানসিকভাবে মোটেও সুস্থ নন।

ওই তরুণী বাংলাদেশি। তিন বছর আগে পাচারের শিকার হয়ে ভারতে গিয়েছিলেন। তাঁকে উদ্ধারের পর মুম্বাইয়ের কাছে শ্রদ্ধা পুনর্বাসন ফাউন্ডেশনে যোগাযোগ করে পুলিশের ওই দল। সংগঠনটি মানসিক রোগীদের নিয়ে কাজ করে। সেখানে পরীক্ষা করে ধরা পড়ে ‘পোস্টপারটাম সাইকোসিসে’ ভুগছেন ওই তরুণী। সন্তান জন্মের পর কোনো কোনো মা বিরল এই মানসিক রোগে আক্রান্ত হন।

চিকিৎসা নেওয়ার পর বর্তমানে ওই তরুণী প্রায় সুস্থ। ওই পুনর্বাসনকেন্দ্রেই সহায়তাকারী একজন কর্মী হিসেবে কাজ করছেন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখন তিনি বাংলাদেশে পাঁচ বছর বয়সী মেয়ের কাছে ফিরতে চান। বলেন, ‘মেয়েকে খুব মনে পড়ে। শিগগিরই তার কাছে ফিরতে চাই। আমি তাকে আর কখনো ছেড়ে যাব না।’

ওই তরুণীকে দেশে ফেরাতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে শ্রদ্ধা পুনর্বাসন ফাউন্ডেশন। বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে মুম্বাইয়ে বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ওই তরুণীর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে। তাঁকে ফেরাতে বাংলাদেশ সরকারের আদেশের জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে।

যেভাবে ভারতে প্রবেশ
শ্রদ্ধা পুনর্বাসন ফাউন্ডেশনের একজন মনোরোগবিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, বাংলাদেশে থাকতে ওই তরুণীর বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছিল। তাঁর পোস্টপারটাম সাইকোসিসের চিকিৎসা চলছিল। কিন্তু একপর্যায়ে তিনি ওষুধ গ্রহণ বন্ধ করে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন। ওই বিশেষজ্ঞ বলেন, মানসিক সমস্যার কারণে তিনি মনে করতেন তাঁর জীবনের ঝুঁকি রয়েছে। তাই বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলেন।

শ্রদ্ধা পুনর্বাসন ফাউন্ডেশনের চিকিৎসক ও কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভারতে যাওয়ার পরের ঘটনা তেমন কিছু মনে করতে পারছেন না ওই তরুণী। কেবল ভাসা ভাসা কিছু বিষয় স্মরণ করতে পারেন। বাংলাদেশ থেকে প্রথমে পশ্চিমবঙ্গে যান তিনি। সেখানে থেকে যান নয়াদিল্লিতে। সর্বশেষ তাঁর ঠিকানা হয় মহারাষ্ট্রে।

তবে পাচার হওয়ার সময়টার কথা মনে আছে ওই তরুণীর। চিকিৎসার বিষয়ে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়ার কথা বলে এক ব্যক্তি কীভাবে তাঁকে সীমান্ত পার করিয়েছিলেন, তা স্পষ্টভাবে স্মরণ করতে পারেন। একটি দলের সঙ্গে সীমান্ত পার হয়েছিলেন বলে জানান তিনি।

সীমান্ত পার হওয়ার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে এই তরুণী বলেন, ‘সীমান্ত পার হওয়ার আগে আমরা সবাই একটি কাঁটাতারের বেড়ার কাছে লুকিয়ে ছিলাম। সশস্ত্র সীমান্ত প্রহরীরা এক পাশ থেকে অন্য পাশে গেলে আমরা একজন একজন করে সীমানা অতিক্রম করেছিলাম।’

পাচারের পর প্রথমে ওই তরুণীকে পশ্চিমবঙ্গে নেওয়া হয়। সেখানে একটি ঘরে অন্য নারীদের সঙ্গে আটকে রেখে তাঁকে অত্যাচার করা হয়। তাঁর অভিযোগ, কলকাতাতে তাঁকে যৌনকর্মে বাধ্য করা হয়েছিল। দিল্লিতেও তাঁকে একই কাজে বাধ্য করা হয়। একপর্যায়ে তিনি পুনেতে এক আত্মীয়ের বাড়িতে পালিয়ে যান। তবে সেখানেও যৌন নির্যাতনের শিকার হতে হয় তাঁকে।

পরিবারের সন্ধান
ভারতে পাড়ি দেওয়ার স্মৃতি তরতাজা হলেও এর আগে বাংলাদেশের স্মৃতিগুলো তেমন মনে করতে পারেন না ওই তরুণী। দিতে পারেননি পরিবার সম্পর্কে সঠিক তথ্য। দেখভালকারীদের শুধু এটুকু বলেছিলেন, তাঁর বাড়ি ইছামতী কলেজ ও ইছামতী নদীর কাছে। জায়গাটি যশোরে। এই জেলার সঙ্গে ভারতের সীমান্ত রয়েছে।

ওই তরুণীর দেওয়া এসব ভাসা ভাসা তথ্যের ভিত্তিতে ‘রাইটস যশোর’ নামে যশোরের একটি এনজিওর সঙ্গে যোগাযোগ করে শ্রদ্ধা পুর্নবাসন ফাউন্ডেশন। এভাবে তাঁর পরিবারের খোঁজ পাওয়া যায়। তাঁর বাবা একজন রিকশাচালক। নিখোঁজ সন্তানের সন্ধান পেয়ে তিনি বেশ খুশি।

তরুণীর বাবা বলেন, প্রায় এক বছর আগে একজন পুলিশ কর্মকর্তা এসে তাঁর মেয়ে সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন। এরপর মেয়েকে ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দেন তিনি। আশা করছেন, যত দ্রুত সম্ভব সন্তানকে কাছে পাবেন।

এদিকে বাড়ি ফেরার জন্য অধীর অপেক্ষায় ২২ বছরের ওই তরুণীও। বাংলাদেশে ফেরার পর ভারতের কোন জিনিসটি তাঁর মন খারাপের কারণ হবে—জানতে চাওয়া হয়েছিল। জবাব দিতে গিয়ে আবেগ তাড়িত হয়ে পড়েন তিনি। বলেন, ‘ভারতে পাহাড় ও হ্রদগুলোর কথা আমার খুব মনে পড়বে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *